বান্দরবান পার্বত্য জেলার আয়তন ৪৪৭৯.০৪ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ৪,০৪,০৯৩ জন। এ জেলার রয়েছে দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাস। সুদূর অতীতে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে ত্রিপুরা রাজ ও আরাকান রাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলার ফলে অঞ্চলটি বহুবার হাত বদল হয়। প্রাচীনকালে পার্বত্য অঞ্চলসহ চট্টগ্রাম ছিল বাংলার হরিকেল জনপদের অর্ন্তভূক্ত। ঐ সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন উপজাতীয় বসতি গড়ে উঠেনি। ৫৯০ খ্রিঃ পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা জুযা রুপা (বীর রাজা) আরাকান রাজাকে পরাজিত করে তার দুই ভাই উদয়গিরি কিলাই এবং মংলাইকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন এবং তারা মাতামুহুরী নদীর দক্ষিণে পাহাড়ে বসবাস করতে থাকে। ৯৫৩ খ্রিঃ আরাকান রাজ সুলা সান্দ্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আবার দখল করে নেন। ১২৪০ খ্রিঃ ত্রিপুরা রাজা পুনরায় এটিকে উদ্ধার করেন। পরে সুলতানী আমলে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশ বিশেষ ক্রমান্বয়ে সুলতান ফকরুদ্দীন মুবারক শাহ্ (১৩৩৮-১৩৪৯), সুলতান জালাল উদ্দিন মুহামমদ শাহ্ (১৪১৮-১৪৩১), সুলতান ইলিয়াস শাহ্ (১৪৫৯-১৪৭৪), সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ (১৪৯৩-১৫১৯) এর শাসনাধীন ছিল। ১৫৭১ সাল থেকে এ অঞ্চল আরাকান রাজা মং ফালাউন ওরফে সিকান্দার শাহ্ এর অধীনে ছিল। ১৬৬৬ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মোগল অধিকারে আসে। ১৭৬০ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলার নবাব মীর কাশিম পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পুরো চট্টগ্রামের দায়িত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে তুলে দেন এবং ১৭৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ইংরেজদের পূর্ণ কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃটিশ শাসনামলে ১৮৬০ সালে ‘রেইন অব ফ্রন্টিয়ার ট্রাইব্স এ্যাক্ট’ অনুসারে চট্টগ্রাম জেলা থেকে পার্বত্য অঞ্চলটিকে (উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে দক্ষিণে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য পর্যন্ত) পৃথক করে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে একটি নতুন পৃথক জেলা সৃষ্টির মাধ্যমে " হিল সুপারিনটেডেন্ট " পদবীতে একজন শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়।
১৮৮১ সালে স্থানীয় প্রথার সাথে মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়। বর্তমান বান্দরবান জেলাটি বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভূক্ত হয়। সার্কেল প্রধানকে বলা হয় সার্কেল চীফ। স্থানীয়ভাবে তারা রাজা নামেও পরিচিত। ১৯০০ সালের মে মাসে ‘দি চিটাগাং হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন-১৯০০’ প্রণয়নের মাধ্যমে ডেপুটি কমিশনারকে জেলার প্রশাসনিক প্রধান নিযুক্ত করা হয় এবং সার্কেল চীফ, মৌজা হেডম্যান, কারবারী, রোয়াজা প্রভৃতি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সার্কেল চীফদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত পাকিস্তানের সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ এর মর্যাদা দেয়া হয় এবং ১৯৬২ সালে তা পরিবর্তন করে ‘ট্রাইবাল এরিয়া’ বলে অভিহিত করা হয়। বর্তমান বান্দরবান পার্বত্য জেলা বৃটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার বান্দরবান, নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা ও লামা থানায় অন্তর্ভূক্ত ছিল। সার্কেল অফিসারগণ থানার প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। ১৯৪৮ সালে বান্দরবান এবং ১৯৭১ সালে লামা থানা পর্যায়ক্রমে মহকুমায় উন্নীত হয়। ১৯৮১ সালের ১৮ই এপ্রিল বান্দরবান মহকুমা ও লামা মহকুমার সমন্বয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা গঠিত হয়। ১৯৮৯ সালে তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে গঠিত জাতীয় কমিটি কর্তৃক উপজাতীয় নেতাদের সাথে বৈঠকের প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ জেলায় বসবাসরত নৃত্বাত্তিক জনগোষ্ঠির রয়েছে আলাদা আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি। এদের অনেক রীতিনীতি, কৃষ্টি, সামাজিক জীবনাচার ও গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মহামান্বিত ও বৈচিত্র্যময় করেছে। এক সময়ের প্রচলিত রাজ প্রথা ও রাজ পুণ্যাহ্ অনুষ্ঠান মূলতঃ এ জেলাতেই হয়ে থাকে। এক সময়ের দুর্গম পাহাড়ী বনাঞ্চল বেষ্ঠিত বিপদসঙ্কুল বান্দরবান আজ কোলাহলপূর্ণ বিকাশমান পর্যটন শহর। দেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ তাজিংড, কেওক্রাডাং, মনোমুগ্ধকর চিম্বুক পাহাড়, বিষ্ময়কর প্রাকৃতিক জলাধার বগালেক, প্রান্তিক লেক, পাহাড়ী ঝর্ণাধারা শৈল প্রপাত ও রিজুক, পর্যটন কমপ্লেক্স মেঘলা, নীলাচল, নীলগিরি এবং মিরিঞ্জার অপরুপ নৈসর্গিক শোভা, বয়ে চলা পাহাড়ী আকাঁ বাকাঁ নদী সাংগু, মাতামুহুরী, রেজু, তারাছা এবং উপজাতীয় জীবন ধারার রহস্যময় হাতছানি, অ-উপজাতি-উপজাতি সমপ্রীতির বৈচিত্র্য পিয়াসী দেশ-বিদেশের ভ্রমন বিলাসী পর্যটকদের যুগযুগধরে আকর্ষণ করে চলেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নৃতাত্বিক বৈচিত্র্যের কারণে এ জেলায় ক্রমবিকাশমান পর্যটন শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। পাশাপাশি জেলার প্রাকৃতিক সম্পদ তথা পাহাড়ে পরিকল্পিত বনায়ন, ফলের চাষ, চা বাগান, ঝিরিতে বাধঁ দিয়ে মাছ চাষের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম। মূলতঃ বান্দরবান এক অনন্য গিরি জনপদ।